কোনো দিন আর ফিরবেন না রাজীব

দুই সপ্তাহ আগে প্রাণ–টগবগে দুচোখে স্বপ্ন জ্বলজ্বল করা রাজীব সদ্যই স্মৃতি হয়ে গেলেন। দুর্ঘটনার পর অনেক অভিমান করে হাসপাতালে একবার বলেছিলেন, ‘রাজীব কে? রাজীব মারা গেছে!’ কার সঙ্গে অভিমান করেছিলেন, সেটা আর কখনো জানা হবে না। লড়াই করে বড় হয়েছিলেন। এই শহর তাঁর লড়াইকে সম্মান দিয়ে দাঁড়ানোর মতো একচুল জায়গাও দিল না। এখন শেষ আশ্রয়ের জন্য তিনি চলে যাচ্ছেন গ্রামের বাড়িতে। আর কখনো স্বপ্ন দেখার জন্য তাঁকে ফিরতে হবে না এই শহরে।   দুই বাসের চাপায় হাত হারানো রাজীব হোসেনের মরদেহ পটুয়াখালীতে তাঁর গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হবে।  রাজীবের মামা মো. জাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাজীবের মরদেহ আজ সকালে ময়নাতদন্ত করা হবে। ময়নাতদন্ত শেষ হওয়ার পর মরদেহ পটুয়াখালীর বাউফলের দাসপাড়ায় নেওয়া হবে। সেখানেই রাজীবকে দাফন করা হবে।  গতকাল সোমবার দিবাগত রাত ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাজীব হোসেন মারা যান। রাজীবের দুজন স্বজন ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) বাচ্চু মিয়া রাতেই বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন।

৩ এপ্রিল বিআরটিসির একটি দোতলা বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন রাজধানীর মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকের (বাণিজ্য) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন (২১)। হাতটি বেরিয়ে ছিল সামান্য বাইরে। হঠাৎ করেই পেছন থেকে একটি বাস বিআরটিসির বাসটিকে পেরিয়ে যাওয়ার বা ওভারটেক করার জন্য বাঁ দিকে গা ঘেঁষে পড়ে। দুই বাসের প্রবল চাপে রাজীবের হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শমরিতা হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর রাজীবকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করা হয়। সাময়িক উন্নতির পর ১৬ এপ্রিল থেকে তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। রাজীবের মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে যায়। সেই থেকে আর জ্ঞান ফেরেনি তাঁর।  রাজীবের ঘটনাটি দেশের মানুষকে নাড়া দিয়ে যায়। রাস্তায় যানবাহনের বেপরোয়া চলাচল নিয়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। ছেলেবেলায় বাবা-মা হারানো রাজীবের বেঁচে থাকার লড়াই, স্বপ্ন—সবকিছুর ইতি ঘটেছে তাঁর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। লেখাপড়া শিখে যখন দুই ভাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছিলেন বাবা-মা হারানো রাজীব, তখন দুই বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতা এমন সংগ্রামী তরুণ প্রাণকে থামিয়ে দিল। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় রাজীব মা আকলিমা খানমকে হারান। বাবা সেই শোকে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। ছিলেন নিরুদ্দেশ। ২০১১ সালে চট্টগ্রামে এক আত্মীয়ের বাসায় তিনি মারা যান। এর আগের তিন বছর তিনি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন।

রাজীব ও তাঁর ছোট দুই ভাই পটুয়াখালীর বাউফলে নানার বাড়িতে ছিলেন। পরে ঢাকায় এসে পোস্ট অফিস হাইস্কুলে ভর্তি হন। খালার বাড়ি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর রাজীব যাত্রাবাড়ীর মেসে গিয়ে ওঠেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতে কম্পিউটার কম্পোজ, গ্রাফিকস ডিজাইনের কাজ শিখছিলেন। ছাত্র পড়াতেন। দম ফেলার ফুরসত পাননি। লক্ষ্য ছিল একটাই, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, ভাই দুটির দায়িত্ব নেওয়া।  রাজীবের সব স্বপ্ন গতকাল রাতে শেষ হয়ে যায়। প্রায় সাত দিন অচেতন অবস্থায় পড়ে থেকে একেবারে চলে গেলেন রাজীব।  এ ঘটনায় করা মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজীবের পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত করা হচ্ছে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে ৩০৪–এর খ ধারায় তদন্ত হবে।  পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে ঘটনার সঙ্গে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.